রাজপথ ও ফুটপাত দখলমুক্ত করতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হকের বেঁধে দেওয়া সময়সীমা ৩ এপ্রিল পার হলেও দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি। আগের মতোই ফুটপাত দখল করে চলছে ব্যবসা-বাণিজ্য। ফুটপাতের ওপর গড়ে তোলা দোকানপাটও আগের মতোই রয়ে গেছে। এ অবস্থায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে নির্দিষ্ট গণ্ডির বাইরে রাস্তা বা ফুটপাত দখল করে গড়ে তোলা দোকানগুলো সিলগালা করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসিসি। এমনকি যেসব দোকানের সামনে ফুটপাতে হকার বসছে, সেসব দোকানির বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পাশাপাশি ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নিজ নিজ এলাকার ফুটপাত ও রাস্তা দখলমুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন মেয়র।
মেয়র আনিসুল হক সমকালকে বলেন, গত ২৭ মার্চ উত্তরা কমিউনিটি সেন্টারে কাউন্সিলরদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ ব্যাপারে বলা হয়েছে। প্রত্যেক কাউন্সিলরকে নিজ নিজ এলাকার ফুটপাত সমস্যার সমাধান করতে হবে। দখলকারীদের উচ্ছেদের পর কীভাবে পুনর্বাসন করা যায়, সে বিষয়েও কাউন্সিলররা কাজ করছেন। মেয়র বলেন, ফুটপাত ও রাস্তা দখলমুক্ত করতে ডিএনসিসির নিয়মিত অভিযান জোরদার করা হবে। নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে ব্যবসা করলেই দোকান সিলগালা করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া জেল-জরিমানা ও আর্থিক দণ্ডও দেওয়া হবে।
এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর (মিরপুর এলাকা) জামাল মোস্তফা সমকালকে বলেন, ‘মেয়রের নির্দেশ অনুযায়ী ইতিমধ্যে ওয়ার্ডের অনেক ফুটপাত দখলমুক্ত করেছি। তবে ফুটপাতে যারা বসে তাদের সরিয়ে দেওয়ার পর আবার বসে পড়ে। তাদেরও উচ্ছেদ করে ফেলব। যাদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ আবার কিছু গরিব মানুষও আছে বলে উল্লেখ করেন জামাল মোস্তফা।
ডিএনসিসি জানিয়েছে, ফার্মগেট, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, কারওয়ান বাজার, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মহাখালী এলাকায় ফুটপাত ও রাস্তা দখল হয়েছে সবচেয়ে বেশি। গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরাতে কিছু দখলদার থাকলেও সমস্যা প্রকট নয়।
বিভিন্ন সময় উচ্ছেদ অভিযানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, তেজগাঁও শিল্প এলাকার ভেতরের রাস্তাগুলো মসৃণ ও প্রশস্ত হলেও ব্যবহার উপযোগী নয়। প্রায় প্রতিটি ফুটপাতে বস্তি ও দোকানপাট গড়ে উঠেছে। ফুটপাতের পাশ ঘেঁষে রাস্তার ওপর রিকশার গ্যারেজ বানানো হয়েছে। দিন-রাত রাস্তার ওপর সার বেঁধে রিকশা রেখে দেওয়ায় দ্রুত গাড়ি চলাচলের সুযোগ থাকে না। গুলশান-তেজগাঁও লিংক রোড থেকে শুরু করে পুরো শিল্প এলাকার ফুটপাতের বেশিরভাগ অংশেই এ দৃশ্য দেখা যায়।
নগরবাসীকে এসব ভোগান্তি থেকে রেহাই দিতে মেয়র আনিসুল হক গত ৩ মার্চ গুলশান ক্লাবে দোকান মালিক সমিতি ও হকার অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে এর সমাধান চান। ওই সময় তিনি এক মাসের মধ্যে হকার ও ব্যবসায়ীদের ফুটপাত ছাড়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, যারা ফুটপাত বা রাস্তা দখল করে ব্যবসা করছেন, তাদের এক মাসের মধ্যে ফুটপাতের সব অবকাঠামো সরিয়ে নিতে হবে।
সিটি করপোরেশন নির্ধারিত স্থানে ব্যবসা করতে হবে। দোকানের সাইনবোর্ডও নির্দিষ্ট আকারে বসাতে হবে। ৩ এপ্রিলের পর এ বিষয়ে কোনো আপত্তি চলবে না। তবে গত রোববার সেই মেয়াদ শেষ হলেও এক মাসের ব্যবধানে ফুটপাতের চেহারায় কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
সরেজমিন রাজধানীর ফার্মগেটের সেজান পয়েন্ট থেকে ইন্দিরা রোডের দিকে এগোতেই দেখা যায়, ফুটপাতের ওপর কাপড়, ঘড়ি-ক্যালকুলেটর, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর দোকান। পশ্চিমে আরেকটু এগোলেই অবস্থা আরও ভয়াবহ। আলু-পটোল, মাছ-মুরগি, তরকারি, ফলমূলসহ কাঁচাবাজার বসে গেছে ফুটপাতের ওপর। কোথাও কোথাও রাস্তায়ও বিস্তৃতি ঘটেছে। এর ফলে ফুটপাত ব্যবহারকারীদের পড়তে হচ্ছে মহাভোগান্তিতে। রাস্তায় লেগে যাচ্ছে যানজট।
মিরপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ১০ নম্বর গোলচত্বরের আশপাশে দখলদারদের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি। গোলচত্বর থেকে চারদিকে যাওয়া চারটি রাস্তারই দুই পাশে দখলদারদের দৌরাত্ম্য। ফুটপাত ও রাস্তার ওপর বসে গেছে কাপড়, জুতা-স্যান্ডেলের দোকান। কয়েকটি স্থানে ফুটপাতের ওপর স্থায়ী দোকানও বানানো হয়েছে। গোলচত্বরের পশ্চিম পাশে ফলের দোকান নিয়ে বসা ইদ্রিস মিয়া বলেন, ফলের দোকানের কারণে কিছু সমস্যা পথচারীদের হলেও দোকানের সামনে যেটুকু জায়গা আছে, সেখান দিয়ে লোকজন হেঁটে যেতে পারে।
ওই এলাকায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি অভিযান চালান ডিএমপির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মশিউর রহমান। ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার জন্য অভিযান চালাতে গেলেও দেখেন ওভারব্রিজের আশপাশ দোকানদাররা এমনভাবে দখল করেছে যে, ফুটপাতে ওঠারই সুযোগ নেই। পরে তিনি ফুটপাত ও ফুট ওভারব্রিজের আশপাশ দখলমুক্ত করেন। তবে সেখানে অবস্থা এখন আগের মতোই। মশিউর রহমান সমকালকে জানান, ওইদিন ফুট ওভারব্রিজের আশপাশ থেকে পাঁচশ দোকান উচ্ছেদ করা হয়। তবে উচ্ছেদের কয়েকদিন পর ওরা আবার বসে পড়ে।
এ প্রসঙ্গে মেয়র আনিসুল হক বলেন, দখল করা রাস্তা ও ফুটপাতের জায়গা ছেড়ে দিয়ে কেবল নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যেই ব্যবসা করতে হবে। কোনো দোকান মালিক নির্দিষ্ট অংশের একটু বেশি ব্যবহার করলে সেই দোকান ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সিলগালা করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া কেউ তার দোকানের সামনে অস্থায়ী দোকান বসতে বাধা না দিলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাংলাদেশ হকার শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি এম এ কাশেম সমকালকে বলেন, ফুটপাতের হকারদের পুনর্বাসনের জন্য তারা দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন। পুনর্বাসন করে ফুটপাত থেকে হকার উচ্ছেদ করে দিলে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে পুনর্বাসন না করা হলে এই দোকানিরা যাবে কোথায়?