বিকেল চারটার কিছু পরে দেশের সব অঙ্গনের শীর্ষ ব্যক্তিত্বসহ সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহনে লোকারণ্যে পরিণত হওয়া আর্মি স্টেডিয়ামে জানাযা সম্পন্ন হয়েছে ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের। জানাযা শেষে তাকে বনানীর কবরস্থানে সমাহিত করার কথা।মেয়রকে শেষবারের মত একনজর দেখা এবং তার কবরে মাটির দেওয়ার আশায় অধীর অপেক্ষায় বনানী কবরস্থানের সামনে থেকে এয়ারপোর্ট রোড পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো হাজার হাজার জনতা। সেই সারিতে ছিলেন সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে শুরু করে সব শ্রেণির নাগরিক। এদের মধ্যে অনেকেই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেয় জানাযায় অংশ নিতে পারেননি।কারণ সব এলাকা থেকে জনতার আর্মি স্টেডিয়ামমুখী ঢলে যানজট ছিল পুরো এয়ারপোর্ট রোড জুড়ে। তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনেকেই আর্মি স্টেডিয়ামে গিয়ে জানাযায় অংশ নিতে পারেননি।
বিকেল তখন পৌনে পাঁচটা।নিরাপত্তাবাহিনীর গাড়িগুলোর হুইসেল শোনা মাত্রই বোঝা গেল মেয়রকে নিয়ে আসা হচ্ছে। জনতার মাঝে চাঞ্চল্য বেড়ে গেল। সারি ভেঙ্গে কেউ কেউ রাস্তায় নেমে আসতে চাইলে তাদের সামলাতে বেগ হয় মিলিটারি পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের।মেয়রকে বহন করা অ্যাম্বুলেন্স কবরস্থানের গেট দিয়ে প্রবেশ করা মাত্রই জনতা রাস্তা ছেড়ে কবরস্থানে ঢুকতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ। কারণ অতিরিক্ত জনগণের ভিড় সামলাতে এবং যেকোন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে অ্যাম্বুলেন্স ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই প্রবেশপথ বন্ধ করে দেয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।শুধু পরিবার এবং নিকটাত্মীয় ছাড়া আর কাউকেউ ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হইনি, মিডিয়াকর্মীদেরও নয়।
কিন্তু জনতা যেন কিছুতেই কোন বাঁধ মানতে চায় না। প্রবেশপথ বন্ধ হওয়ার পর বহু চেষ্টা করেও ভেতরে না ঢুকতে পেরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে জনতার আকুল আবেদন, দয়া করে ভেতরে ঢুকতে দেন, মেয়রের কবরে একমুঠো মাটি দিতে চাই। খুব আশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, মাটি দিয়ে দিয়েই চলে যাবো।
পরে অবশ্য জনতার চাওয়া পুরণ হয়েছে। মেয়রকে কবরে রাখার পরপরই খুলে দেওয়া হয় কবস্থানের প্রবেশ পথ। তখন জনতা সুযোগ পায় মেয়রের কবরে মাটি দেওয়ার এবং দাফন শেষে দোয়ায় অংশ নেওয়ার।
সাম্প্রতিক অতীতে কোন ব্যক্তির জানাযায় এত লোকের অংশগ্রহনের ঘটনা বিরল।আর্মি স্টেডিয়াম পুরোটাই ভরে যায় মানুষে।বিরল সব শ্রেণির মানুষের এমন ভালোবাসাও।মৃত্যুর খবর জানার পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমগুলো আনিসুল হকময়। সেখানে সবশ্রেণির মানুষের পক্ষ থেকে কেবল ভালোবাসা, স্তুতি এবং স্মৃতিচারণ।
মেয়রের জন্য জনতার এমন উচ্ছ্বাসের কারণ কী? উত্তর পাওয়া গেল ভাস্কর মৃণাল হকের কথায়। সাধারণ জনগণের সারিতে তিনিও কবরস্থানের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন মেয়রের আসার পথ চেয়ে। মেয়রের সঙ্গে কোন আনুষ্ঠানিক কাজ না করলেও কেবল ভালোবাসা থেকেই তিনি এসেছিলেন তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে।
মেয়র সম্পর্কে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেন: আনিসুল হক একজনই; তার জায়গায় একজন নয়-আরও দশজন আসতে পারেন। কিন্তু তার বিকল্প হওয়া সম্ভব নয়।
নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যায় এ ভাস্কর বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর কাজ বঙ্গবন্ধু ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে হবে না, রবীন্দ্রনাথের কাজ রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে হবে না; তেমনি পিকাসোর ছবি আঁকা আরেকজনকে দিয়ে হবে না। কাজেই একজন না আরও দশজন আসতে পারেন (আনিসুল হকের জায়গায়) কিন্তু আমরা এই জিনিসটা আর পাবো না।’
তার মতে, অন্যরা শুধু বক্তৃতা দিতে জানে, কাজের বেলায় নেই। উনি কিন্তু কথা কম বলে কাজ করে গেছেন। গোপনে গোপনে রাস্তা-ঘাট অলি-গলি সবকিছু তিনি উন্নয়ন করে গেছেন। সুতরাং বিকল্প পাওয়া সম্ভব নয়। সবাই স্বপ্ন দেখে শুধু নিজেকে ভারি করার জন্য; কিন্তু সত্যিকার অর্থেই নাগরিকদের কল্যাণে কাজ করে গেছেন আনিসুল হক।
আনিসুল হক এমন একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন যিনি কেবল স্বপ্ন দেখতেনই না তার বাস্তবায়নেও চেষ্টা করতেন। সুন্দর ঢাকা নগরীর যে স্বপ্ন মানুষের জন্ম দিতে পেরেছিলেন সে পথে এগিয়েছিলেন অনেকটা। কিন্তু এক মরণব্যাধীর কাছে মাঝপথেই তার অগ্রযাত্রা থেমে যাওয়ায় হতাশা নেমে এসেছে সাধারণ নাগরিক থেকে শুরু করে সর্বত্র। আমাদের আশা, পরবর্তীতে আনিসুল হকের জায়গায় যিনি দায়িত্বে আসবেন, নিজের যোগ্যতা এবং কর্মদক্ষতায় তিনিও জনতার মনে জায়গা করে নেবেন এবং হয়ে উঠবেন সত্যিকার অর্থেই একজন জনতার মেয়র।