‘আমার এখনও ভাবতে কষ্ট হয়, চার বছর হয়ে গেছে আনিস আমাদের চোখের আড়াল হয়ে গেছেন! তবে চোখের আড়াল হওয়া মানেই মনের আড়াল হওয়া নয়। তাকে আমরা প্রত্যেকে, পরিবারের সবাই আমাদের চিন্তা-চেতনায়, আমাদের আদর্শে ধারণ করি। তিনি চলে গেছেন, কাল (আজ মঙ্গলবার) চার বছর পূর্ণ হবে। কিন্তু এখনও তিনি আমাদের সবার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে আছেন।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে স্মরণ করে আবেগঘন কণ্ঠে এভাবেই স্মৃতিচারণ করছিলেন তার সহধর্মিণী বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রুবানা হক। গতকাল সোমবার সমকালের কাছে দেওয়া ‘আমার আনিসুল হক’ শীর্ষক এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রয়াত স্বামীকে স্মরণ করে রুবানা হক বলেন, আমাদের চার সন্তান। আমাদের নাতি-নাতনিকে আনিস দেখেননি, শুধু বড় নাতিকে একদিনের জন্য কোলে নিতে পেরেছেন। তারপর আমাদের আরও দুই নাতি-নাতনি হয়েছে। চার নম্বরজন হতে যাচ্ছে। আনিস যেখানে যেভাবেই আছেন, সেখান থেকেই তাদের দেখছেন। ঢাকাবাসী তাকে অনেক ভালোবেসেছেন। অনেক অনেক বেশি ভালোবাসা দিয়েছেন। আমরা মানুষের ভালোবাসার মূল্য বুঝি। তাদের কৃতজ্ঞতা জানাই।
প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের আজ চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৫ সালে তিনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মেয়র পদের জন্য মনোনয়ন পেয়ে বিজয়ী হন। ২০১৭ সালের ২৯ জুলাই ব্যক্তিগত সফরে সপরিবারে যুক্তরাজ্যে যান। সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৩ আগস্ট তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তখন তার মস্তিস্কের রক্তনালির প্রদাহ ধরা পড়ে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ২৩ মিনিটে লন্ডনের ওয়েলিংটন হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ২ ডিসেম্বর আর্মি স্টেডিয়ামে জানাজার পর তাকে বনানী কবরস্থানে ছোট ছেলে শারাফ ও মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয়।
প্রয়াত আনিসুল হকের সঙ্গে পরিচয় ও সংসারের স্মৃতিচারণ করে রুবানা হক বলেন, আনিসের সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশক থেকে। বিটিভিতে তার একটা অনুষ্ঠান ছিল ‘এখনই’, সেখানে একটি বিতর্ক হয়েছিল। বিষয় ছিল, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে/গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে।’ বুয়েটের একদল ছেলে ‘গুণবান পতি যদি থাকে তার সনে’ অংশ নিয়ে ছেলেদের পক্ষ নিয়ে আমাদের বিরোধিতা করছিল, আর আমরা রমণীদের প্রশংসা করছিলাম। বয়স কম ছিল, দেখা হয়েছিল তখনই।
আনিসের সঙ্গে আমার ২৭ বছরের ঘর করা। তার সঙ্গে আমার প্রচুর স্মৃতি। একসঙ্গে আমাদের ঘোরা কম হতো। কাজের চাপে আমরা ভীষণ ব্যস্ত থাকতাম। কিন্তু অনেক ঠেলেঠুলে আমাদের ২৫তম বিয়েবার্ষিকীতে আমরা জেনেভায় যাই। সেখানে আমাদের মেয়ে ছিল। তার কাছে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেবার খুব মজা হয়েছিল। এর বাইরে আমাদের বাচ্চাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা, হাইস্কুল, গ্র্যাজুয়েশন সবকিছু। আসলে প্রতিটি দিনই ছিল আনন্দমুখর। অনেক অধ্যায় তো একসঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের। কাজেই গোটা ২৭ বছরের বিবাহিত জীবনের সবটাতেই, সব জায়গাতেই আনিস। ঝগড়া করিনি, তা নয়। প্রচুর ঝগড়া আমরা করেছি। আসলে তা ছিল এক ধরনের স্মার্টনেস।
রুবানা হক নিজেও দেশের একজন স্বনামখ্যাত নারী উদ্যোক্তা। তিনি মোহাম্মদী গ্রুপের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) নির্বাচিত প্রথম নারী সভাপতি ছিলেন। তিনি একজন কবি ও লেখকও। ২০০৬ সালে তিনি কবিতার জন্য সার্ক সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।
রুবানা হক বলেন, যখন আমার বিয়ে হয়, তখন তো ঢাকা শহরে একটা ফ্ল্যাটও আমাদের ছিল না। সেখান থেকে আস্তে আস্তে কষ্ট করে করে আজকে একটা জায়গা পর্যন্ত অন্তত আমরা এসে পৌঁছেছি। সবচেয়ে বড় অর্জন আমি মনে করি, তিনি অনেক সম্মানের জায়গায় আমাদের রেখে গেছেন।
‘সংসার থেকে কর্মজীবন- দুই জায়গাতেই আপনারা ছিলেন পরস্পরের সঙ্গী। দু’জনের কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন সফল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদী গ্রুপ। সহকর্মী আনিসুল হককে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন’ জানতে চাইলে রুবানা হক সমকালকে বলেন, সহকর্মী আনিস আসলে ভীষণ চালাক মানুষ ছিলেন। কারণ সবসময়ই আমাকে বলতেন- রুবু, সিইও ইজ অলওয়েজ দ্য বেস্ট সিইও হোয়েন হি ইজ নেভার মিসড। তার মানে তিনি ফাঁকি দেবেন আর আমি কাজ করব। শুধু স্বামী-স্ত্রী হয়ে নয়, বন্ধুর মতো একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম।
প্রয়াত মেয়রের অনেক পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে রুবানা হক বলেন, আনিস যখন মেয়র হলেন তখন এ শহর বদলে দেওয়ার তার অনেক স্বপ্ন ছিল। সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল মানুষের জন্য তিনি কাজ করবেন, মানুষ তাকে ভালোবাসবে, তার কাজের স্বীকৃতি দেবে। তার অনেক প্রজেক্টের মধ্যে ‘সবুজায়ন’টা ভীষণ পছন্দের ছিল। সবুজ ঢাকা হবে, একটা আধুনিক ঢাকা হবে, খুব ভাবতেন তিনি। কীভাবে ডিজিটাল সিটি গড়ে তোলা যায় সেটা নিয়ে ভাবতেন। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য পরিশোধন প্লান্ট দেখতে জাপানে গিয়েছিলেন- অনেক কিছু অনেকভাবে চিন্তা করেছিলেন। নগর পরিবহন নিয়ে ভেবেছেন- কীভাবে এগোনো যায়। সবচেয়ে বড় কাজ ছিল, আনিস আসলে অবৈধ দখলে থাকা বেশকিছু সরকারি জমি পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। সেটি ঠিকভাবে করা হয়ে ওঠেনি। একটা ঘটনা মনে পড়ছে, খুব ক্ষমতাবান এক ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন, আমাকে আপনার এই সমস্যা সমাধান করে দিতেই হবে। আনিস বললেন, এটা অবৈধ। জমি সরকারকে ফিরিয়ে দিতেই হবে। ভদ্রলোকও নাছোড়বান্দা। শেষমেষ আনিস একটি ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, এই নম্বরে কথা বলুন। তিনি আপনার সমস্যা সমাধান করতে পারবেন। ভদ্রলোক বাইরে গিয়ে ফোনে কথা বলে এসে আনিসকে বললেন, এটা একটা কাজের কাজ করলেন? আপনি আমাকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নম্বর দিয়ে দিলেন? জবাবে আনিস বললেন- ‘কী করব ভাই! আপনার সমস্যা তো উনি ছাড়া আর কেউ সমাধান করতে পারবেন না। তাই দিয়ে দিয়েছি।’ আনিসের প্রচণ্ড সেন্স অব হিউমার ছিল। এই হলো আনিস।
আনিস অল্প সময়ে সাধারণ মানুষের অনেক ভালোবাসা কুড়াতে পেরেছেন তার সততা, নিষ্ঠা ও কর্ম দিয়ে। এ রকম এক হাজার আনিস যেন আগামী দু’বছরে বাংলাদেশে হয় এবং তারা যেন অনেক অনেক যত্ন করে আমাদের দেশটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।