প্রয়াত মেয়র আনিসুলের হকের পর থেকে ঢাকার মেয়র পদটি এবং তাদের কার্যাবলি সবার নজরে আসছে আজকাল। এর আগে অনেকে এটিকে শুধুই একটি বড় পদ হিসেবে আঁকড়ে ধরে শুয়ে-বসে দিন কাটিয়েছেন—কাজের কাজ কিছু করেছেন বলে মনে পড়ে না। ফলে, আনিসুল হক-পরবর্তী মেয়রদের কাছে এখন পদটি একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আর সেই সূত্রেই, বর্তমান সময়ে ঢাকা নিয়ে দুটি ঘটনা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এক. ঢাকার মেয়রদ্বয় ঢাকঢোল পিটিয়ে শহরের ঝুলন্ত তার কেটে-ছিঁড়ে সরিয়ে মাটির নিচে নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন শহরের সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য। দুই. ঢাকার পানি নিষ্কাশনের দায়ভার ‘ওয়াসা’ থেকে সরিয়ে ‘সিটি করপোরেশন’ অর্থাত্ মেয়রদ্বয়ের ঘাড়ে বর্তেছে। আপাতদৃষ্টিতে এ দুটি ঘটনা ভিন্ন মনে হলেও তাদের মাঝে নিবিড় যোগসূত্র আছে বইকি!

‘প্রথম’ সিদ্ধান্তটির পর, এটি অনেকের কাছেই বিব্রতকর মনে হয়েছিল। কেননা, এই তারগুলোর অধিকাংশই ইন্টারনেট আর ডিশের লাইন। এই করোনাকালে যেখানে দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে বড় মাধ্যম হচ্ছে ইন্টারনেট, আর ঘরবন্দি মানুষের বিনোদনের একমাত্র উপায় ডিশ চ্যানেল—সেখানে এই সিদ্ধান্তটি কতটা যৌক্তিক অনেকে এ প্রশ্ন তুলেছেন। উপযুক্ত সময় বলে একটি কথা আছে বইকি! বলা হচ্ছে, সব তার মাটির নিচে নিয়ে যাওয়া হবে। খুবই চমত্কার প্রস্তাব—তবে কতটা বাস্তবসম্মত? কবে শুরু হবে? এখন শুরু করলেও কম করে পাঁচ বছর। আর এদিকে একটু বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যায় ঢাকার রাস্তাঘাট। ভাবুন একবার—শহরটি জলে ডুবে থাকলে এই ভূগর্ভস্থ তারের ওপর নির্ভর ইন্টারনেট আর ডিশ লাইনগুলোর কী দুরবস্থা হবে! কিন্তু তার কিছুদিন পরই ‘দ্বিতীয়’ সিদ্ধান্তটি এলো। না, মেয়দ্বয় তথা সরকারের বোধোদয় হয়েছে।

আসলে গতানুগতিকভাবে নেতাদের কাছে কিছু বিষয় সব সময়ই প্রাধান্য পেয়ে থাকে, যা কিনা দৃশ্যমান। যেমন—ইতিপূর্বে ‘সোডিয়াম লাইট’ লাগিয়ে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল ‘তিলোত্তমা ঢাকা’ বানানোর। অথচ এই মেগা সিটিটির প্রায় ৯০ শতাংশের বেশি জায়গা ‘পয়ঃশোধনাগার’-এর আওতাবহির্ভূত। পুরান ঢাকার ‘পাগলা’য় কিছু ‘প্রাথমিক শোধন’ হয়, যা কিনা প্রায় ব্রিটিশ আমলে নির্মিত। মাটির নিচের বিষয় বলেই হয়তো গুরুত্ব পাচ্ছে না। জলাবদ্ধতার সমস্যাটিও একইভাবে দিন দিন প্রকট হচ্ছে। অথচ এটি দেশের রাজধানী ও সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতি বছর জলাবদ্ধতার কারণে সড়কের ক্ষতি প্রায় হাজার কোটি টাকা। পরিবেশ, রোগবালাই আর সময়ের মূল্য না হয় বাদই দিলাম। তারপর যদি ডিজিটাল বাংলাদেশের ‘লাইফলাইন’ এই সমগ্রতার মাটির নিচ দিয়ে যায়, আর জলে ডুবে থাকে—পুরো অর্থনীতি অচল!

সমস্যাটির সমাধান যে খুব কঠিন ছিল তা কিন্তু নয়। একটি শহরের পানি নিষ্কাশনের বৈজ্ঞানিক সমাধানের ক্ষেত্রে অতি সাধারণ কিছু মৌলিক বিষয়ই এখানে উপেক্ষিত। যেমন—ন্যূনতম খোলা জায়গা রাখা, প্রাকৃতিক খাল-লেকগুলো সংরক্ষণ, ড্রেনগুলো পরিষ্কার রাখা, বর্জ্য-ব্যবস্থাপনাটি ন্যূনতম মানে উন্নীত করা এবং নির্মাণ বিধিমালায় পানি ও পয়োনিষ্কাশন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া। আর আজকাল একটি বিষয় বারবার বলা হচ্ছে যে, আইন দ্বারা বিধিবদ্ধ করে বৃষ্টির পানি ধরে রাখাকে বাধ্যতামূলক করা।

আসলে শহরটিকে আর বাড়তে না দিয়ে, আরো আগেই ‘বিকেন্দ্রীকরণ’ করা উচিত ছিল। সরকারের এক ইঞ্চি জায়গা তো নয়ই, বরং জনসাধারণেরও যত খোলা জায়গা আছে, সরকার তা দখলে নিয়ে তা সংরক্ষণ করা উচিত। কেননা বৃষ্টি হলে এখন এর পুরোটাই চলে আসছে ড্রেনে, অতঃপর রাস্তায়, যা আগে প্রায় ৩০-৫০ শতাংশ মাটিতে শোষিত হতো। তবে, বাস্তবচিত্র এর ধারেকাছেও নয়।

শহরটি যখন সারা বর্ষায় হাঁটুপানিতে তলিয়ে যাবে, তখন বিদেশি বিশেষজ্ঞ এনে, ‘মাটির ভেতরে পানি প্রবেশ করিয়ে’ সমস্যা সমাধানের লোভ দেখিয়ে প্রকল্প তৈরি করা হবে শত শত কোটি টাকার। এই যেমন ঢাকার চার পাশের নদীগুলো নর্দমায় পরিণত করে, আর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ৩০০ থেকে ৫০০ ফুট নিচে নামবার পর এখন সুদূর পদ্মা-মেঘনা-যমুনা থেকে পাইপ দিয়ে পানি এনে ঢাকার পানি সরবরাহের তোড়জোড় চলছে। কথায় আছে, ‘সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়’। প্রয়াত মেয়র আনিসুলের হকের স্বপ্নের ঢাকা নির্মাণ শুরু হয়েছিল উত্তরার ব্যাপক উন্নয়ন আর রাস্তাগুলোর সংস্কারের মাধ্যমে। চমত্কার এই সুন্দর রাস্তাগুলো আজকাল পানি নিষ্কাশন পাইপ নির্মাণের নামে কেটে-চিড়ে ছারখার। এ এক তুঘলকি কাণ্ড। কেন করছে, কী পরিকল্পনা নিয়ে করছে, কেউ জানে না। দরিদ্র জনগণের ট্যাক্সের টাকা নিয়ে এগুলো মশকরা বই কিছু নয়।

সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পৃথিবীর সব বড় সভ্যতাই নদী-জলাধার বা সমুদ্রের পাড়ে গড়ে উঠেছে। আর সেক্ষেত্রে ঢাকা ছিল একটি অনন্য নগরী, যা কিনা চারপাশ দিয়ে নদীবেষ্টিত। তদুপরি, শহরটির মাঝখান দিয়ে বয়ে গিয়েছিল অজস্র ছোট-বড় খাল। ফলে জলাবদ্ধতা বিষয়টি এখানে প্রায় অসম্ভব হওয়ার কথা। কিন্তু আফসোসের বিষয়, এই খালগুলো দখলমুক্ত করতে কারো কোনো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না, যতটা না তারা আগ্রহী বড় বড় প্রকল্প নিতে। নেই অবশিষ্ট খালগুলো আবর্জনামুক্ত করার চেষ্টা। শুধু একটা ভালো উদাহরণ আছে আমাদের, আর তা হচ্ছে হাতিরঝিলটিকে রক্ষা করা। অন্যথায় এই শহরটির জলাবদ্ধতা যে এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াত! হাতিরঝিল, গুলশান-বনানী-বারিধারা আর ধানমন্ডি—এ ধরনের অবশিষ্ট কয়েকটি লেককে যদি অন্তত সংযুক্ত করে সমন্বিতভাবে পানি ধরে রাখার কাজটি করা যেত, তাহলেও পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হতো। উচিত ছিল প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে লেকগুলো সংস্কারের মাধ্যমে এদের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা। তাছাড়া ঢাকাকে ঘিরে আছে শহররক্ষা বাঁধ। যাতে করে ভেতরের পানি বাইরে বের হওয়ার একমাত্র পথ মাত্র কয়েকটি পাম্প স্টেশন—যা বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় একেবারেই অপ্রতুল। তদুপরি নিরবিচ্ছিন্ন ড্রেনেজ ব্যবস্থার অভাবে, বৃষ্টির পানি দ্রুত পাম্প স্টেশনগুলোতে গিয়ে সময়মতো পৌঁছাতেও পারছে না।

তবে সব দোষ যে সরকারের তাও নয়। ঢাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুরবস্থা, যার জন্য অনেকাংশে নাগরিক অসচেতনতাই দায়ী। এই জলাবদ্ধতা সমস্যাটিকে আরো প্রকট করছে। ড্রেন-লেক যা আছে তাও সব বন্ধ হয়ে আছে প্লাস্টিক আর আবর্জনায়। সর্বোপরি ওয়াসা, রাজউক আর সিটি করপোরেশন—এই তিনটি সংস্থার মাঝে সমন্বয় ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা একেবারেই অনুপস্থিত। প্রকৃত অর্থে খাল-বিলগুলো রক্ষা করার ক্ষেত্রে ওয়াসার চাইতে সিটি করপোরেশন অনেক বেশি ক্ষমতাশীল এবং এটি বরাবরই তাদের করা উচিত ছিল। অন্যদিকে, বাংলাদেশ নির্মাণ বিধিমালা, যার ওপর ভিত্তি করে ঢাকায় বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে, তাতে পানি নিষ্কাশন বিষয়টি একেবারেই উপেক্ষিত। নিয়মানুযায়ী একটা ভাগ খোলা জায়গা রাখা হলেও, জনগণের কোনোই ধারণা নেই কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ। এই খোলা জায়গায় বৃষ্টির পানি শোষণ করার কথা, অথচ তা বাড়িওয়ালা পরে ঢেকে ফেলছে গ্যারেজ কিংবা শেড বানিয়ে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিটি বাড়ির নিচে ‘বৃষ্টির পানির আধার’ নির্মাণের কাজটি নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী এ মুহূর্তে বাধ্যতামূলক করার কোনোই বিকল্প নেই। ভাবুন একবার, একটি বড় বৃষ্টির পর ঢাকার লাখ লাখ বাড়ির নিচে মিলিয়ন-মিলিয়ন ঘন ফুট পানি জমা হয়ে যাচ্ছে। রাস্তা থাকত খট-খটে শুকনা। সেই পানি আবার আপনি ব্যবহার করতে পারতেন কম গুরুত্বপূর্ণ অ-পানীয় ব্যবহার গুলোতে। যেমন—টয়লেট ফ্ল্যাশ। নিচের আধারটি ছিদ্রযুক্ত ইট ব্যবহার করে বানানো হলে তা ভূগর্ভস্থ পানির স্তরকে ভরাটে সাহায্য করত। এসব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাগুলোর দিকে যথার্থভাবে নজর দেওয়া গেলে জলাবদ্ধতা সমস্যাটি কখনই এত প্রকট হতো না।

পরিশেষে, ঢাকার মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি, বাহ্যিক সৌন্দর্য্যের পাশাপাশি মাটির নিচেও নজর দিন। এর জন্য যে খুব বেশি কিছু করা প্রয়োজন তা নয়, বরং দরকার সুচিন্তিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। ঝুলন্ত তার সরিয়ে শহরের সৌন্দর্যবর্ধনের কাজটি নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এটি কখনই টেকসই হবে না যদি না জলাবদ্ধতা রয়ে যায়। ফলে বীরবিক্রমে, দুর্বল ডিশমালিকদের তার কাটতে আপনারা যতটা পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন, এবার নিজেদের শৌর্য-বীর্য প্রদর্শন করে খালগুলো উদ্ধার আর খোলা জায়গাগুলো রক্ষা করুন—প্রকৃত অর্থেই কাজের কাজ হবে।

লেখক :পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ; অধ্যাপক, সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ও পরিচালক, সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভিসেস, নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়